জামদানি

জামদানি শাড়ি: ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণ

জামদানি শাড়ির অর্থ ও উৎপত্তি

জামদানি শাড়ি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় ফ্যাশন পণ্য। জামদানি শব্দের অর্থ হল এক প্রকারের নকশা করা মিহি কাপড় বা শাড়ি, যা সাধারণত হাতে বোনা হয়। এটি একটি ফার্সি শব্দ, যেখানে “জাম” অর্থ কাপড় এবং “দানা” অর্থ বুটি, অর্থাৎ বুটিযুক্ত কাপড়। একারণে মনে করা হয় মুসলমানেরাই ভারত উপমহাদেশে জামদানির প্রচলন ও বিস্তার করেন।

জামদানির আরেক অর্থ পাওয়া পায়, ‘জামদানি তাঁত’ থেকে উদ্ভূত, যেখানে ‘জাম’ মানে কাপড় এবং ‘দানি’ মানে সূক্ষ্ম বুনন। সুক্ষ্ম বুননকেই আসলে বুটি বলা হয়৷ আর জামদানি শাড়ি তার সূক্ষ্ম বয়ন এবং জটিল নকশার জন্য পরিচিত।

জামদানি শাড়ির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর ভর্তি ও সূক্ষ্ম নকশা। জামদানি শাড়িতে সাধারণত ফুল, পাতা, বা জ্যামিতিক আকৃতি দেখা যায়। তাঁতীরা দক্ষতা ও ব্যবসায়িক সৃজনশীলতার মাধ্যমে প্রতিটি জামদানি শাড়িকে এক একটি শিল্পকর্মে পরিণত করেন। এই শাড়ির মধ্যে ব্যবহার করা রংগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক, যা অন্যসব শাড়ির তুলনায় একে স্বতন্ত্র করে তোলে।

জামদানির বৈশিষ্ট্য ও নকশার বিশেষত্ব

জামদানি শাড়ি হাতে বুনা হয় এবং অত্যন্ত জটিল নকশায় তৈরি করা হয়। জামদানি শাড়িতে বিভিন্ন রঙ ও নকশা থাকে, যা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনন্য পরিচায়ক।

বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে জামদানির গুরুত্ব

জামদানি শুধু পোশাক নয়, বরং বাংলাদেশী নারীর সংস্কৃতির একটি প্রতীক। বর্তমান যুগে জামদানি শাড়ি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে, যা বাংলার ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে জামদানি শাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম। জামদানি শাড়ির ইতিহাস প্রায় ২,০০০ বছর পুরনো। এটি প্রথমে মুসলিম শাসন আমলে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক লেখায় জামদানি শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এর প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যকে প্রমাণ করে। বাংলার রাজা-রাণীদের মধ্যে এই শাড়ি খুব জনপ্রিয় ছিল, এবং এটি এখনো অনেকের জন্য প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে বিয়ে বা উৎসবের সময়।

জামদানি শাড়ির প্রাচীন ইতিহাস

জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়, আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে, পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি বইতে এবং বিভিন্ন আরব, চীন ও ইতালীর পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনাতে। কৌটিল্যের বইতে বঙ্গ ও পুন্ড্র এলাকায় সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে, যার মধ্যে ছিল ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী।

নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তার গ্রন্থ স্রিল সিলাই-উত-তওয়ারিখে রুমি নামের রাজ্যে সূক্ষ্ম সুতি কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার বর্ণনা অনুসারে বোঝা যায়, রুমি রাজ্যটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সোনারগাঁও এলাকাস্থিত সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। যোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিচ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলও ঢাকার মসলিনের প্রশংসা করেছেন।

আরেক ঐতিহাসিক টেলরের জামদানির বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনানুসারে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১০*২ হাত মাপের ও ৫ শিক্কা ওজনের এক টুকরো আব-ই-রওয়ান এর দাম ছিল ৪০০ টাকা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা।

ঐতিহাসিক বর্ণনা, শ্লোক প্রভৃতি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় দুকূল বস্ত্র থেকে মসলিন এবং মসলিনে নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হত। মূলতঃ বাংলাদেশের ঢাকা জেলাতেই মসলিন চরম উৎকর্ষ লাভ করে। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি এলাকা মসলিনের জন্য সুবিখ্যাত ছিল। ইউরোপীয়, ইরানী, আর্মেনীয়, মুঘল, পাঠান প্রভৃতি বণিকেরা মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানেরাও এই শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন।

বিকাশ

ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। এ সময় দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। আঠারো শতকে ইংরেজ দলিল থেকে জানা যায় মলমল খাস ও সরকার-ই-আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবীর উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দপ্তর ছিল এবং এখানে দক্ষ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার প্রভৃতি কারীগরদের নিবন্ধন করে রাখা হত। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপে লক্ষ্য রাখা। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রায় একলক্ষ টাকা মূল্যমানের মলমল-খাস মোঘল দরবারে রপ্তানি করা হত।

১৭৪৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দিল্লীর বাদশাহ, বাংলার নবাব ও জগৎ শেঠের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার জামদানি কেনা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় ব্যবসায়ীগণ প্রায় নয় লাখ টাকার মসলিন কেনে। তবে আঠারো শতাব্দীর শেষের দিকে মসলিন রপ্তানি অনেকাংশে হ্রাস পায়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে। এদের নিযুক্ত গোমস্তারা নিজেদের স্বার্থে তাঁতিদের উপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁতীরা কম মূল্যে কাপড় বিক্রি করতে রাজী না হলে তাদের মারধোর করা হতো। অবশ্য তাঁতীদের উপর অত্যাচার ঠেকাতে কোম্পানি আইন প্রণয়ন করেছিল।

মোগল যুগে জামদানি শাড়ি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মুঘল সভ্যতার বিলাসিতার নিদর্শন হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীকালে, জামদানি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় এবং ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ সালে দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷

বর্তমানে জামদানি শাড়ি শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে এই শাড়ির কদর বাড়েছে। এটি শুধুমাত্র নারী সাজসজ্জার জন্য নয়, বরং বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। জামদানি শাড়ি বললে, বাঙালির ঐতিহ্য ও শিল্পের স্মৃতি বরাবর জড়িত থাকে।

 

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় হিসেবে জামদানি

আধুনিক জামদানি শাড়ি এখন শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী শাড়ি হিসেবে নয়, বরং ফ্যাশনের একটি অংশ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। অনেক ডিজাইনার জামদানি শাড়িকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন, যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জামদানি শাড়ি এখন বিভিন্ন রঙ ও ডিজাইনে পাওয়া যায়, যা প্রতিটি মহিলার রূপকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।

প্রাথমিক যুগে, জামদানি বুনন ছিল নির্বাচিত কিছু কারিগরদের দ্বারা চর্চা করা একটি দক্ষতা, প্রায়শই রাজদরবার এবং অভিজাত পরিবারগুলিতে । এই জটিল নকশাগুলি ‘ইকাত’ কৌশল ব্যবহার করে বোনা হত, যার মধ্যে কাপড়ে বোনা হওয়ার আগে সুতাকে প্রতিরোধ-রঞ্জন করা জড়িত।

জামদানি শাড়ি তৈরি করার প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং পরিশ্রমসাধ্য। একজন দক্ষ তাঁতী একটি শাড়ি তৈরি করতে ৪৫ থেকে ৬০ দিন সময় নেন। এটি তৈরির সময় তাঁতীর সন্তুষ্টির পাশাপাশি, সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় মেধা, শ্রম ও সময়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকে।

এটি মনে রাখতে হবে যে জামদানি শাড়ি শুধুমাত্র একটি পোশাক নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি প্রতীক। জামদানি শাড়ির মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে আঁকছি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পরিচিতি বৃদ্ধি করছি। বর্তমানে জামদানি শাড়ি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়ে উঠছে, এবং বহু দেশেই এটি জনপ্রিয় ফ্যাশন হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

অতএব, জামদানি শাড়ি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং আধুনিক ফ্যাশনের মোড়ের মাঝের একটি আদর্শ উদাহরণ। এটি শুধু সময়ের পরিবর্তনের সাথেই চলতে থাকে না, বরং একটি সাহসী স্টাইল বিবেচনা হিসেবে প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হয়। জামদানি শাড়ির প্রতি এই ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে চলুক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top